ট্যুরের আগের করণীয়ঃ
১। ইন্ডিয়া ভিসা উইথ ফুলবাড়ি বা চ্যাংরাবান্ধা পোর্ট। সিকিম বা দার্জিলিং এর জন্য ফুলবাড়ি পোর্টটাই সুবিধা।
২। টাকা টু ডলার কনভার্সন এবং ডলার এনডোর্স।
৩। বাসের টিকিট (আমি ১ মাস আগেই কেটেছিলাম)।
৪। ট্রাভেল ট্যাক্স (ট্যাক্স দিয়ে যাইনি। তাই বর্ডারে পে করেছি)।
৫। জব করলে NOC (এবং তার ফটোকপি)।
এছাড়াও সিকিমে যেহেতু সবকিছুতেই প্যাকেজ কিনে যেতে হয়, তাই গ্রুপ হয়ে ঘোরা ভাল। ৭ জনের গ্রুপ আইডিয়াল কারণ জিপে ৭জন পর্যন্ত মোটামুটিভাবে বসা যায়। এর বেশি হলে কষ্ট। আবার মানুষ কম হলে মাথাপিছু খরচ বাড়বে।
প্রায় এক মাস আগে শ্যামলী এন আর ট্রাভেলস এ কেটে রেখেছিলাম টিকিট।
ঢাকা টু শিলিগুড়ি। পার টিকিট ২০০০ টাকা। হুন্দাই এসি বাস। আমরা সন্ধ্যা ৬টায় বাসের কাউন্টারে যাই। বাস ছাড়ে সাড়ে ৬টায়। বাসটা দুর্দান্ত। সিটগুলি শুয়ে ফেলানো যায়। অনেক কমফোর্টেবল। বর্ডারে পৌঁছাতে যেহেতু ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা লাগে, তাই একটা ভালো বাস বা সিটের ভূমিকা অপরিসীম।
বর্ডারে পৌঁছাই সকাল সাড়ে ৭টায়। যেহেতু বর্ডার ৯টার আগে খোলে না, তাই ওখানেই দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করতে হল। এর মধ্যে শ্যামলী এন আর এর লোকেরা আমাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট আর ৬৫০ টাকা করে নিল (ট্রাভেল ট্যাক্স + বর্ডার পাস করে দেয়ার ফি)। তারপর ৯টার সময় দুই বর্ডারের ইমিগ্রেশন শেষ করতে করতে ১০টা বেজে গেল। জব হোল্ডার হলে NOC দেখতে চাইবে এবং এক কপি ফটোকপি রেখে দিবে।
খুব সহজে বর্ডার ক্রস করার পর শ্যামলী এন আর এর ইন্ডিয়ান কাউন্টার থেকে ডলার টু রুপি কনভার্ট করলাম (১ ডলার = ৬৯ রুপি)। সাথে ভোডাফোনের সিম নিলাম ৪৫০ রুপি দিয়ে (১.৫ জিবি ইন্টারনেট প্যাকেজসহ)।
এসবকাজ বর্ডারে শেষ করে ১১টায় আমরা রওয়ানা হলাম শিলিগুড়ির দিকে। শ্যামলী এন আর ছোট ছোট গাড়ির ব্যবস্থা রেখেছিল সকল যাত্রীদের শিলিগুড়ি পৌঁছে দেবার জন্য। আধঘন্টারও কম সময়ে আমরা শিলিগুড়ি চলে আসলাম। (এজন্যই ফুলবাড়ি পোর্ট বেটার। চ্যাংড়াবান্ধা পোর্ট নিলে এই আধাঘন্টার জার্নি ৩ ঘন্টা লাগে)।
পৌঁছেই আমরা রিটার্ন টিকিট করে নিলাম। (রিটার্ন টিকিট সাথে সাথেই করে নেওয়াই ভালো। একান্তই না নিতে চাইলে ওদের কার্ড বা নাম্বার নিয়ে আসবেন। যাতে করে বুকিং দিতে পারেন ফোনের মাধ্যমে।
ওখান থেকে খুব কাছেই SNT. আমরা ৫০ রুপি দিয়ে অটোতে করে SNT গেলাম। SNT যাবার কারণ দুটো।
প্রথমত, সিকিম যাবার পারমিশন নেয়া। এটা সিকিম যাত্রাপথে রাংপোতেও নেয়া যায়। কিন্তু SNT তে কাজটা করে রাখলে (ফর্ম ফিলাপ, ছবি জমা, পাসপোর্ট আর ভিসার ফটোকপি দেয়া) রাংপোতে জাস্ট একটা সিল নিলেই হয়। আর না হলে যাত্রাপথে আপনি যে বাস বা জীপে যাবেন তাকে অনেকটা সময় অপেক্ষায় রেখে পারমিশন নিতে হবে যেটা বাকি যাত্রীদের জন্যে বিরক্তিকর। আর মাঝে মাঝে রাংপোতে ট্যুরিস্টদের ভীড়ও বেশি হয়।
SNT যাবার দ্বিতীয় কারণ হল, ওখান থেকে শুলিগুড়ি টু গ্যাংটকের বাস ছাড়ে আধা ঘন্টা পরপর। জীপের চেয়ে আমরা বাসকেই পছন্দ করছিলাম। ১২টায় পৌঁছে দেখি ১ঃ৩০ এ একটা এসি বাস আছে। নন এসি বাস ১৫০ রুপি, আর এসি বাস ২৮০ রুপি। আমরা এসি বাসই নিলাম। কারণ অনেক গরম শিলিগুড়িতে। বাসের টিকিট কেটে আমরা পারমিশন নিয়ে নিলাম। ওরা পারমিশনের একটা কপি দিবে। এটা অবশ্যই সবসময় সাথে রাখবেন। কিছু ফটোকপিও করে রাখবেন। ও হ্যাঁ, বলে রাখা ভালো, আপনি অবশ্যই নিজের সাথে ১০ কপি ছবি, ১০টি করে পাসপোর্ট আর ভিসার ফটোকপি সাথে রাখবেন। সিকিমে কাজে লাগবে।
পারমিশন নেয়ার পরে হাতে ঘন্টাখানেক সময় ছিল। আমরা SNT এর ক্যান্টিনে লাঞ্চ করে নিলাম। খুব ভালো খাবার। একটা রুই মাছের থালি নিলে ভাত, মাছ, ডাল, সবজি পাওয়া যায়। মাছ বাদে আবার সবকিছু রিফিলও করা যায়। পার থালি ১৪০ রুপি। খুব ভালো একটা লাঞ্চ করার পর ১ঃ৩০ টার সময় গ্যাংটকের বাসটায় উঠলাম। আমরা বাসের কন্ডাক্টরকে আগেই জানিয়ে রাখলাম যে আমাদের রাংপো থেকে পারমিশন নিতে হবে।
বিকাল সোয়া ৫টার দিকে রাংপোতে আসলাম। সেখানে কোন ভীড়ই ছিল না। ২ মিনিটে সিল নিয়ে আবার বাসে উঠে পড়লাম।
গ্যাংটকে পৌঁছলাম সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়।আমরা উঠলাম Hotel Utpala তে পার ডে ১৬০০ রুপি দিয়ে। M G Marg গ্যাংটকের সবচেয়ে হ্যাপেনিং প্লেস। তাই এখানকার হোটেল প্রাইস একটু বেশি। M G Marg এর বাইরে থাকলে কিছু কম খরচেই হোটেল পাবেন।
হোটেলে ব্যাগ রেখে রাত সাড়ে ৮টায় আমরা কয়েক জায়গায় কথা বললাম এবং প্রাইস জানলাম। শেষ পর্যন্ত ৫ হাজার রুপিতে সাঙ্গু লেকের প্যাকেজ নিলাম। প্রত্যেকে ৩ কপি ছবি, পাসপোর্ট, ভিসার ২ কপি করে ফটোকপি আর সিকিমের পারমিশনের ১ কপি ফটোকপি দিয়ে আমরা প্যাকেজটা নিয়ে নিলাম। পরদিন সকালে ৯টায় ইনোভা গাড়িতে রওয়ানা দিব।
তখন বাজে রাত সাড়ে ৯টা। সবাই ক্ষুধার্ত। পাশের একটা বাঙালী হোটেলে ভাত মাছের থালি খেয়ে নিলাম। ২০০ রুপি পার থালি।
রাত ১০টার পর আবার সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়। খাওয়া শেষে রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত M G Marg ঘুরলাম। খুব সুন্দর জায়গা সারাদিনের ক্লান্তি ভর করা শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
সকাল ৮টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ঠিক সাড়ে ৯টায় আমরা জীপে উঠলাম। প্রায় সাড়ে ৩ ঘন্টা লাগলো সাঙ্গু লেক যেতে। পথিমধ্যে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম ১০০ রুপি দিয়ে। যাওয়ার রাস্তাটা অনেক সুন্দর। সাঙ্গু লেক পৌঁছে আমরা তো ওয়াও। পাহাড়ের মাঝখানে চমৎকার লেক। আমাদের দেশের বান্দরবনের বগা লেক যেরকম। দুটো দুরকম সুন্দর। লেকের পাশ ধরে উঁচু পাহাড়ের মাঝে অনেকক্ষণ হাঁটলাম। ওখানে ক্যাবল কার আছে। পার পারসন ৩২৫ রুপি দিয়ে আমরা ক্যাবল কারে উঠলাম। একদম চূড়ায় নিয়ে যাবে। ওখানে গিয়ে মেঘের খেলা দেখা যাবে। আমরা কিছুক্ষণ সেখানে থেকে আবার ক্যাবল কারে নিচে নেমে আসলাম। দুপুরে আড়াইটার দিকে আবার ব্যাক করলাম। ৪টা বাজলো (আসতে কম সময় লাগে কারণ নিচে নামে। পাহাড়ে উঠতে বেশি সময় লাগে বলে যেতে বেশি সময় লেগেছে)।
পৌঁছেই আমরা নর্থ সিকিমের প্যাকেজ নেই। এখানেও দরদাম করতে হবে। আমরা ১৩৫০০ রুপির প্যাকেজ নেই ১ রাত ২ দিনের। এই প্যাকেজে নর্থ সিকিমের লাচুং গ্রামে যাতায়াত, ইয়ুম্থাং ভ্যালী ঘুরানো, হোটেলে থাকা, ১টি ব্রেকফাস্ট, ১টি লাঞ্চ আর ১টি ডিনার ইনক্লুডেড। সাথে আরো ২৫০০ রুপি এড করতে হয়েছে জিরো পয়েন্টে গিয়ে বরফ দেখবো বলে। টোটাল ১৩৫০০ + ২৫০০ = ১৬০০০ রুপির প্যাকেজ ।
আপনি চাইলে আরো কিছু খরচ বাড়িয়ে ২ রাত ৩ দিনের প্যাকেজ নিতে পারেন। লাচুং এর পাশেই লাচেন নামে আরেকটি গ্রাম আছে। সেটা দেখতেই এই বাড়তি দিন আর খরচ। আমরা যখন গিয়েছি তখন লাচেনের রাস্তা বন্ধ ছিল।
সকাল সাড়ে ১০টায় রওয়ানা হলাম নর্থ সিকিমের উদ্দেশ্যে। বিশাল জার্নি। মাঝখানে অনেক সুন্দর সুন্দর কিছু ঝর্ণা ছিল। গাড়ি থামিয়ে থামিয়ে দেখলাম। মাঝে এক জায়গায় লাঞ্চ করে নিলাম পার পারসন ২০০ রুপি দিয়ে। পুরো গাড়ির জার্নিটা আনন্দেরও, কষ্টেরও। আনন্দ কারণ খুব সুন্দর ভিউ। পাহাড়, ঝর্না। খারাপ কারণ জীপে জার্নি ভালো লাগে না। যে বড় বড় বাঁক খায়, পেট উলটে আসে।
সন্ধ্যা ৬টায় পৌঁছলাম নর্থ সিকিমের লাচুং গ্রামে। ছোট্ট সুন্দর একটা গ্রাম। হোটেলটাও ভালোই ছিল। আমরা ফ্রেশ হয়ে বের হলাম। দেখি নাস্তা দিচ্ছে। আনলিমিটেড চা উইথ আনলিমিটেড বিস্কুট।তারপর ৭টা থেকে ১০টা গ্রামটা ঘুরলাম। মাঝে ডিনারও করলাম এই হোটেলে সব খাবার আনলিমিটেড এবং প্যাকেজের অংশ। ভেজেটেরিয়ান হোটেল। ভাত, সব্জি, আলুর দম, সুজি, রুটি, ডাল এগুলো। খাওয়া ভালো।
গুগল ম্যাপে দেখবেন সিকিমের এই ছোট্ট লাচুং গ্রামটার ৪ পাশে ৪ দেশ। চায়না, নেপাল, ভূটান আর ইন্ডিয়া তো আছেই। উপরে আকাশ ভরা তারা। সামনে পাহাড়ের উপর পাহাড়। রাত বাড়ে। আকাশে তাকিয়েই থাকি। আহারে! জীবন এতো ছোট কেন!
খুব ভোরে উঠতে হল।ব্রেকফাস্ট সেরে (রুটি,৭টার মধ্যে জীপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য প্রথমে জিরো পয়েন্ট। ৯টায় পৌঁছলাম। কিছুটা disappoint হলাম। ভেবেছিলাম পুরো বরফের চাদরে ঢাকা পাহাড় দেখবো। কিন্তু সেই তুলনায় বরফ অল্পই ছিল। আসলে বর্ষাকাল হয়তো আদর্শ সময় নয়। জানুয়ারি থেকে এপ্রিলই হয়তো ভালো। যাক, যেটুকু আছে সেটুকুর উপরেই চলল দাপাদাপি আর বরফ ছোড়াছুঁড়ি। ঘন্টাখানেক থেকে গেলাম ইয়ুমথাং ভ্যালী। বেস্ট। চারপাশে পাহাড়, মেঘ, ঝিরিপথ, বিশাল সবুজ মাঠ, মানে মাথা নষ্ট। প্রায় আড়াই ঘন্টা ঝিম মেরে এখানেই বসে রইলাম। হোটেলে ফিরলাম ১টায়। আড়াইটা নাগাদ আমরা জীপে করে আবার গ্যাংটকে ফেরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।